ধরুন, আপনি প্রতিদিন ঠিকমতো খাচ্ছেন, ব্যায়াম করছেন, স্ট্রেস কম- তবুও হঠাৎ একদিন বুক ধড়ফড় করছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বা বাম হাত ধরে যাচ্ছে! আপনি কি জানেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ মানুষ হৃদরোগজনিত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন, যার একটি বড় অংশই ঘটে ‘রক্তনালির ব্লক’ বা হার্ট ব্লকের কারণে? এই ব্লকগুলো অনেক সময় শরীরে কোনো সিগন্যাল না দিয়েই আচমকা বিপদ ডেকে আনে। অথচ সঠিক সময়ে ‘রক্তনালির ব্লক নির্ণয়ে পরীক্ষা’ করালে এই বিপদ এড়ানো সম্ভব। কিন্তু কোন টেস্টগুলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য? কোনগুলো সহজে করা যায়? কিভাবে শুরু করবেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবো আমাদের আজকের এই আর্টিকেল থেকে।
বর্তমানে আমাদের দেশে হার্ট ব্লকের সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, বিশেষ করে ৪০ বছর বয়সের পর পুরুষ ও নারীদের মধ্যে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (BMA) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে অন্তত ৩ জন কোনো না কোনোভাবে হৃদরোগজনিত ঝুঁকিতে রয়েছেন। অথচ অধিকাংশই জানেন না, শরীরে কোনো উপসর্গ না থাকলেও রক্তনালির মধ্যে ব্লক তৈরি হতে পারে, যা সময়ের সাথে বিপজ্জনক আকার ধারণ করে। তাই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে কার্যকর বিষয় হলো- প্রতিরোধ ও পূর্বাভাস। এবং এর একমাত্র উপায় হলো যথাসময়ে “রক্তনালির ব্লক নির্ণয়ে পরীক্ষা” করা। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে ব্লক ধরা পড়লে অনেক আগেই চিকিৎসা শুরু করা যায়, যা স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও কমিয়ে আনে।
রক্তনালির ব্লক নির্ণয়ে পরীক্ষা: সময়মতো করলেই বাঁচতে পারে জীবন
রক্তনালির ব্লক নির্ণয়ের জন্য সময়মতো সঠিক পরীক্ষা করানো জীবনের জন্য হতে পারে পরম আশীর্বাদ। অনেক সময় হার্ট ব্লকের প্রাথমিক লক্ষণ যেমন হালকা বুক ধরা, ক্লান্তিভাব বা শ্বাসকষ্টকে মানুষ অবহেলা করে, যার ফলে সময় নষ্ট হয় এবং বিপদ বাড়ে। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন কিছু নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে সহজেই হার্টের রক্তনালির অবস্থা জানা সম্ভব। এর মধ্যে অন্যতম হলো ইসিজি (ECG), যা হৃদযন্ত্রের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ করে এবং কোনো ব্যতিক্রম দেখা দিলে সংকেত দেয়। ইকোকার্ডিওগ্রাম (ECHO) হৃদপিণ্ডের গঠন ও পাম্প করার ক্ষমতা বিশ্লেষণ করে, যা ব্লকের প্রভাব নির্ণয়ে সাহায্য করে। তবে সবচেয়ে কার্যকর ও নির্ভুল পরীক্ষা হলো করোনারি এনজিওগ্রাম, যা রক্তনালির ভেতরের ব্লকের অবস্থান ও পরিমাণ সরাসরি চিত্রের মাধ্যমে দেখায়। চিকিৎসকের পরামর্শে এসব পরীক্ষা নিয়মিত বা উপসর্গ দেখা দিলেই করানো উচিত, বিশেষ করে যাদের পারিবারিক ইতিহাস, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা বয়সজনিত ঝুঁকি আছে। মনে রাখা জরুরি, সময়মতো এই পরীক্ষাগুলো না করালে অনেক সময় প্রথম লক্ষণটাই হতে পারে হার্ট অ্যাটাক বা আকস্মিক মৃত্যু। তাই সচেতনতা ও আগাম পরীক্ষাই হতে পারে হার্টের জীবনের রক্ষাকবচ।
হার্ট ব্লক কী এবং এটি কেন ভয়ঙ্কর?
হার্ট ব্লক হলো এমন একটি অবস্থা, যেখানে হৃদপিণ্ডের রক্তনালিতে (বিশেষত করোনারি আর্টারিতে) চর্বি, কোলেস্টেরল ও অন্যান্য উপাদান জমে ‘প্লাক’ তৈরি করে এবং রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হৃদপিণ্ড পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পায় না, যা মারাত্মক জটিলতার কারণ হতে পারে। হার্ট ব্লকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো- এর প্রাথমিক লক্ষণ অনেক সময় স্পষ্ট নয় বা উপেক্ষিত হয়, অথচ এটি ধীরে ধীরে বড় বিপদের দিকে নিয়ে যায়, যেমন হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর বা আকস্মিক মৃত্যু। তাই হার্ট ব্লককে শুধু একটি সাধারণ স্বাস্থ্যসমস্যা না ভেবে এটি যে জীবননাশের কারণও হতে পারে, সেই সচেতনতা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
উপসর্গ না থাকলেও কেন ব্লক হতে পারে?
উপসর্গ না থাকলেও হৃদপিণ্ডে ব্লক হতে পারে, কারণ অনেক সময় রক্তনালিতে জমে থাকা চর্বি বা কোলেস্টেরল ধীরে ধীরে প্লাক তৈরি করে, যা শরীর তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করে না। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, স্থূলতা বা পারিবারিক ইতিহাস আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ব্লক ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে কাজ করে। ধমনি যতক্ষণ না ৭০-৮০% পর্যন্ত ব্লক হয়, ততক্ষণ অনেকের শরীরে তেমন লক্ষণ প্রকাশ পায় না, অথচ ভিতরে ভিতরে হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এই কারণে অনেক সময় প্রথম উপসর্গই হয়ে ওঠে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাক বা আকস্মিক মৃত্যু। তাই উপসর্গ না থাকলেও নিয়মিত হার্ট চেকআপ করানো এবং ঝুঁকি থাকলে সতর্ক থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কোন কোন পরীক্ষায় রক্তনালির ব্লক ধরা পড়ে
ইসিজি (ECG) – সহজ ও দ্রুত পদ্ধতি
ইসিজি (Electrocardiogram) হলো হার্টের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপের একটি সহজ, দ্রুত এবং অল্প খরচের পরীক্ষা। এই টেস্টে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ইলেকট্রোড বসিয়ে হৃদস্পন্দনের ওঠানামা ধরা হয়, যা কাগজে গ্রাফ আকারে প্রকাশ পায়। যদি কোনো অংশে অক্সিজেনের ঘাটতি থাকে বা রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে ইসিজিতে তা অনেক সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তবে ইসিজি সবসময় ব্লকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে না, বিশেষ করে যদি ব্লক ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে থাকে বা রোগী পরীক্ষা সময় কোনো উপসর্গ অনুভব না করেন। তবুও এটি প্রাথমিকভাবে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বা কোনো অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করার জন্য একটি কার্যকর ও জরুরি পরীক্ষা। অনেক সময় চিকিৎসকরা এটি করেই পরবর্তী উন্নত টেস্টের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করেন।
ইকোকার্ডিওগ্রাম – হার্টের ছবি দেখে ব্লক চিহ্নিত
ইকোকার্ডিওগ্রাম বা ECHO হলো একটি আল্ট্রাসাউন্ড-ভিত্তিক পরীক্ষা, যার মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের গঠন, গতি ও রক্তপ্রবাহের অবস্থান সরাসরি মনিটরে দেখা যায়। এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ, ব্যথাহীন এবং হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা, ভালভের অবস্থা, ও ফ্লুইড জমার মতো বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে।
যদিও ECHO সরাসরি ব্লক দেখায় না, তবে এটি ব্লকের প্রভাবে হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করতে পারে। যেমন, কোন অংশে হার্ট দুর্বল হয়ে গেছে, সেখান থেকে অনুমান করা যায় সেই অংশে ব্লক থাকতে পারে। ব্লক সংক্রান্ত সমস্যার পাশাপাশি ECHO অন্যান্য হৃদরোগের ক্ষেত্রেও উপযোগী টেস্ট।
ট্রেডমিল টেস্ট (TMT) – চলতে চলতে হার্টের সক্ষমতা যাচাই
TMT বা ট্রেডমিল টেস্টে রোগীকে হাঁটতে বা দৌড়াতে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ে, এবং সেই সময় ইসিজি রেকর্ড করা হয়। এর মাধ্যমে দেখা হয়, শারীরিক চাপের সময় হার্টের কার্যক্ষমতা কেমন থাকে এবং রক্তপ্রবাহে কোনো বাধা দেখা দেয় কি না। চলতি অবস্থায় হৃৎপিণ্ড যদি ঠিকমতো অক্সিজেন না পায়, তাহলে ইসিজিতে তার লক্ষণ ধরা পড়ে।
এই পরীক্ষাটি এমন রোগীদের জন্য কার্যকর, যাদের প্রাথমিকভাবে কোনো লক্ষণ নেই বা সাধারণ ইসিজিতে কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। তবে যাদের আগে থেকেই হৃদরোগ আছে বা হার্ট দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে এই টেস্ট না করে সরাসরি অ্যাঞ্জিওগ্রাফির মতো উন্নত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সিটি কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম – ব্লকের ছবি এক ক্লিকে
সিটি কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম হলো একটি আধুনিক, নন-ইনভেসিভ টেস্ট, যেখানে সিটি স্ক্যান ও কন্ট্রাস্ট ডাইয়ের সাহায্যে হার্টের ধমনির 3D ছবি তোলা হয়। এই পদ্ধতিতে রক্তনালির ভেতরে কোনো ব্লক আছে কি না, সেটি সরাসরি কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখা যায়। এতে ব্যথা নেই এবং প্রক্রিয়াটি খুবই দ্রুত।
এই টেস্ট প্রাথমিক পর্যায়ে ব্লক আছে কি না তা জানার জন্য ভালো, বিশেষ করে যাদের ঝুঁকি আছে কিন্তু বড় কোনো উপসর্গ নেই। তবে জটিল বা গুরুতর ব্লক থাকলে কিংবা স্টেন্ট/বাইপাসের আগে পরে উন্নত বিশ্লেষণ করতে চাইলে চিকিৎসকরা অনেক সময় কনভেনশনাল অ্যাঞ্জিওগ্রাফিকেই বেছে নেন।
কনভেনশনাল অ্যাঞ্জিওগ্রাফি – সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য টেস্ট
কনভেনশনাল অ্যাঞ্জিওগ্রাফি (যা অনেক সময় কোরোনারি ক্যাথেটারাইজেশনও বলা হয়) হলো ব্লক শনাক্তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নির্ভুল পরীক্ষা। এতে রোগীর রক্তনালিতে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে রেডিওঅ্যাক্টিভ ডাই প্রয়োগ করা হয়, এবং এক্স-রে দিয়ে রক্তপ্রবাহের অবস্থা সরাসরি দেখা হয়। এতে ব্লকের অবস্থান, পরিমাণ ও গভীরতা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
যেহেতু এটি একটি ইনভেসিভ (অর্থাৎ শরীরের ভেতরে যন্ত্র প্রবেশ করানো হয় এমন) প্রক্রিয়া, তাই এটি সাধারণত তখনই করা হয় যখন রোগীর উপসর্গ গুরুতর অথবা চিকিৎসার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রয়োজন পড়ে। এই পরীক্ষার ভিত্তিতেই চিকিৎসক নির্ধারণ করেন যে এনজিওপ্লাস্টি, স্টেন্ট বসানো নাকি বাইপাস সার্জারির প্রয়োজন আছে কি না।
কোন পরীক্ষাটি কবে ও কার জন্য?
হৃদরোগ নির্ণয়ে কোন পরীক্ষা কবে এবং কার জন্য প্রযোজ্য, তা নির্ভর করে রোগীর বয়স, উপসর্গ ও ঝুঁকির মাত্রার উপর। যদি কারও বয়স ৪০ বছরের বেশি হয় এবং তার হালকা বুক ধরা, শ্বাস নিতে কষ্ট বা ঘনঘন ক্লান্তির মতো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে প্রাথমিকভাবে ইসিজি (ECG) ও ইকোকার্ডিওগ্রাম করানো উচিত। এগুলোর মাধ্যমে হৃদপিণ্ডের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ ও পাম্পিং ক্ষমতা বিশ্লেষণ করা যায়। উপসর্গ তীব্র হলে বা উপরের টেস্টে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে পরবর্তী ধাপে ট্রেডমিল টেস্ট (TMT) কিংবা সিটি কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, যাদের উপসর্গ খুব স্পষ্ট- যেমন ব্যথা হাত বা ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ে, ঘনঘন শ্বাসকষ্ট হয় বা আগেও হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস রয়েছে- তাদের ক্ষেত্রে সরাসরি কনভেনশনাল কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করানো হয়। এটি সব বয়সেই প্রযোজ্য, যদি চিকিৎসক মনে করেন এটি জরুরি। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে, যাদের একাধিক ঝুঁকি ফ্যাক্টর আছে, তাদের আগেই একবার সিটি অ্যাঞ্জিওগ্রাম বা মিনিমাম ইনভেসিভ পদ্ধতির মাধ্যমে হার্টের অবস্থা জানিয়ে রাখা ভালো। অর্থাৎ, পরীক্ষা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সময় ও রোগীর ব্যক্তিগত ঝুঁকিগুলো বিচার করা অত্যন্ত জরুরি।
বয়স, উপসর্গ ও ঝুঁকিভিত্তিক পরীক্ষার বাছাই
যেসব মানুষ ৩০ বছর বয়সের নিচে এবং সুস্থ, তাদের সাধারণত নিয়মিত হৃদরোগ পরীক্ষা করানোর দরকার পড়ে না- তবে যদি পরিবারের ইতিহাস থাকে বা কোনো উপসর্গ দেখা দেয়, তখন ইসিজি ও রক্ত পরীক্ষা প্রাথমিকভাবে করানো উচিত। ৩০-৪০ বছর বয়সের মধ্যে থাকা মানুষ যদি ধূমপান, স্থূলতা বা উচ্চ কোলেস্টেরলে ভোগেন, তাদের প্রতি ১-২ বছরে একবার হার্টের স্ক্রিনিং করানো বাঞ্ছনীয়। এই বয়সে TMT ও ইকোকার্ডিওগ্রাম কার্যকর হতে পারে উপসর্গ ছাড়া ঝুঁকি নিরূপণে।
৪০ বছরের পর থেকে যেহেতু হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে, তাই তখন নিয়মিত হার্ট চেকআপ অত্যন্ত প্রয়োজন। উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, অন্তত একবার সিটি কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম বা TMT করে হার্টের রক্তপ্রবাহের অবস্থা যাচাই করা উচিত। কেউ যদি আগেই হার্ট অ্যাটাক, বাইপাস, বা স্টেন্ট নেওয়ার ইতিহাসে থাকেন, তাহলে কনভেনশনাল অ্যাঞ্জিওগ্রাফি হতে পারে তার জন্য সবচেয়ে উপযোগী এবং সঠিক টেস্ট।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও পরিবারের ইতিহাস থাকলে কী করবেন?
যদি কারও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস অথবা পরিবারের কারও হৃদরোগের ইতিহাস থাকে, তাহলে উপসর্গ না থাকলেও তাকে “ঝুঁকিপূর্ণ” হিসেবে ধরা হয়। এদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ব্লাড প্রেসার, সুগার ও কোলেস্টেরল লেভেল চেক করার পাশাপাশি প্রতি ১-২ বছরে একবার ECG এবং ECHO করানো উচিত। এছাড়া, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী TMT বা সিটি কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম করিয়ে রক্তনালির অবস্থা আগেভাগে জেনে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।

ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সমস্যাটা হয়, কারণ তাদের অনেক সময় ব্লকের উপসর্গ স্পষ্ট হয় না- যাকে “সাইলেন্ট হার্ট ডিজিজ” বলা হয়। তাই এই শ্রেণির রোগীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে কনভেনশনাল অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা যায়, যাতে নির্ভুলভাবে ব্লকের অস্তিত্ব যাচাই করা যায়। মনে রাখতে হবে, এই পরীক্ষা দ্রুত চিকিৎসা নির্ধারণে সাহায্য করে এবং সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দেয়, যা জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে পরীক্ষাগুলোর প্রাপ্যতা ও খরচ
বাংলাদেশে হার্টের রক্তনালির ব্লক শনাক্তে ব্যবহৃত প্রায় সব আধুনিক পরীক্ষা এখন দেশের বড় বড় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সহজলভ্য। ইসিজি (ECG) এবং ইকোকার্ডিওগ্রাম (ECHO) তুলনামূলকভাবে সস্তা ও সাধারণ পরীক্ষা, যার খরচ প্রাইভেট ক্লিনিকে সাধারণত ২০০–১,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। ট্রেডমিল টেস্ট (TMT) একটি মাঝারি খরচের পরীক্ষা, যা ২,৫০০–৫,০০০ টাকার মধ্যে সম্পন্ন করা যায়। আধুনিক ও উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর সিটি কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম সাধারণত ঢাকার কিছু প্রিমিয়াম হাসপাতালে পাওয়া যায় এবং এর খরচ প্রায় ১৫,০০০–৩০,০০০ টাকার মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কনভেনশনাল কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি সরকারি হাসপাতালে করালে ভর্তিসহ কিছুটা কম খরচে (১০,০০০–২০,০০০ টাকা) করা সম্ভব হলেও, বেসরকারি হাসপাতালে এর খরচ ৩০,০০০–৬০,০০০ টাকা বা তারও বেশি হতে পারে, হাসপাতালের মান ও ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে।
তবে দেশের বাইরের তুলনায় বাংলাদেশে এই টেস্টগুলো তুলনামূলকভাবে কম খরচে করানো যায়, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালে আগেভাগে সিরিয়াল বা রেফারেন্স পেলে। তবে খরচের পাশাপাশি সঠিক জায়গা ও দক্ষ কারিগর নির্বাচন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভুল রিপোর্টের ভিত্তিতে ভুল সিদ্ধান্ত রোগীর জীবন বিপন্ন করতে পারে। তাই উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই উপযুক্ত স্থানে পরীক্ষা করানো সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
উপসংহার
শেষ কথা হলো- রক্তনালির ব্লক কোনো রহস্য নয়, এটি নির্ণয়ের জন্য এখন আমাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি, যেমন ইসিজি (ECG), ইকোকার্ডিওগ্রাম, ট্রেডমিল টেস্ট (TMT), সিটি কোরোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাম ও কনভেনশনাল অ্যাঞ্জিওগ্রাফি। এসব টেস্ট সহজলভ্য ও অনেক ক্ষেত্রেই অল্প খরচে করানো সম্ভব। তাই শরীরের প্রতি সচেতন হন, হার্টের প্রতি দায়িত্বশীল হোন। মনে রাখবেন, সময়মতো একটি পরীক্ষা আপনাকে বহু বছরের জীবন উপহার দিতে পারে। “রক্তনালির ব্লক নির্ণয়ে পরীক্ষা” করানো কেবল রোগীর নয়, পরিবারের ভবিষ্যৎও রক্ষা করতে পারে। সুতরাং এখনই সময় নিজেকে জিজ্ঞাসা করার- আমার হার্ট কি ঠিক আছে?